লগ্নকুমার তঞ্চঙ্গ্যা (১৯৫২ - বর্তমান)
চাকমা সার্কেলাধীন ১০০নং ওয়াগ্গা মৌজার দেবতাছড়ি গ্রামের মুরুংছড়া আগায় দেত্তাছড়ি মোইন পাড়া নামক স্থানে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে কবি, গল্পকার, ছড়াকার, গীতিকার লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যার জন্ম। তিনি তপস্যা তঞ্চঙ্গ্যা ও অর্মিলা তঞ্চঙ্গ্যার তৃতীয় সন্তান।
লগ্নকুমারের শৈশব কাটে দেবতাছড়ি গ্রামে। ১৯৫৯ সালে তিনি স্থানীয় দেবতাছড়ি এল. পি. স্কুলে ভর্তি হন ও পরে পার্শ্ববর্তী ঘাগড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কৃতিত্বের সাথে তিনি প্রতিটি ক্লাশে উত্তীর্ণ হতেন। কিন্তু পিতার আর্থিক অসংগতির কারণে বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে থাকত। সৌভাগ্যের বিষয় যে, তখন তিনি বিভিন্ন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির আর্থিক সহযোগীতা লাভ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার্থী ছিলেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলায় বাংলাদেশ সরকার সেই পরীক্ষা বাতিল করে। উক্ত পরীক্ষা ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত হলে তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন।
মেট্রিকুলেশন পাশের পর ৯৯নং ঘাগড়া মৌজার তৎকালীন হেডম্যান ও ইউ.পি চেয়ারম্যান ¯েœহ কুমার দেওয়ানের সহায়তায় তিনি হোসাইন বোল্ডার কোম্পানিতে যোগ দেন। চাকুরী রত অবস্থায় তৎকালীন আন্ডার গ্রাউন্ড সংগঠন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (পিবিএসপি) এর সংস্পর্শে আসেন এবং ১৯৭৩ সালে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যোগদান করেন।
সংগঠনে কাজ করার সময়ে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের সুযোগ পান এবং বিভিন্ন জনের সাথে পরিচিতি ঘটে। ১৯৭৬ সালে পিবিএসপি’র বিধি অনুসারে কবিরতœ কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার মেজো কন্যা সুনন্দা প্রভা তঞ্চঙ্গ্যার সাথে তাঁর পরিণয় ঘটে। এর সাত বছর পর ১৯৮৩ সালে সংগঠনের দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে নির্বাচনে তিনি কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির পূর্ণাঙ্গ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পার্বত্যাঞ্চলের সামগ্রীক আঞ্চলিক দায়িত্ব লাভ করেন।
১৯৮৪ সালে পিবিএসপি’র এক কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা সংগঠন থেকে সরে দাঁড়ালে তিনি যারপরনাই হতাশ হন। অতপর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি তিনি রাজস্থলী আর্মি ক্যাম্প কমান্ডারের নিকট আত্মসমর্পন করেন এবং সংগঠন থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি এগারো বছর পর্যন্ত এ সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।
১৯৮৭ সালে তিনি বিলাইছড়ি উপজেলার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এর এক বছর পর দীঘলছড়ি উপজাতীয় আবাসিক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও সুপারিনটেন্ডেন্ট এর দায়িত্ব লাভ করেন। সেখান থেকে তিনি ১৯৮৯ সালে রাজস্থলীর চিংখ্যং স্কুলে বদলী হন। পরবর্তী বছর রাঙ্গামাটি পি.টি.আই হতে সি-ইন-এড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সি-ইন-এড প্রশিক্ষণ কালীন পি.টি.আইতে তিনি ‘দেয়ালিকা/৯১’ এর সম্পাদক ছিলেন পি,টি,আইতে থাকা কালীন কোনো এক সময় রাঙ্গামাটি শহরের ‘রিজার্ভ মুখ সাহিত্য ক্লাব’ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগীতায় ‘মুই গম’ নামে একটি কবিতা পাঠ করে দ্বিতীয় হন। সেই থেকে তাঁর সাহিত্য সাধনা শুরু হয়।
চাকুরী জীবনে তিনি বাংলাদেশ স্কাউটস এর সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি কাব লিডার বেসিক কোর্সে প্রশিক্ষণ নেন এবং ১৯৯৮সালের নভেম্বরে ‘উড ব্যাজার’ সনদ প্রাপ্ত হন। তিনি শিক্ষার্থীদের স্বরচিত গান শেখাতেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেসব গান পরিবেশন করা হতো। এসব অনুষ্ঠানে তাঁর শিক্ষার্থীরা সুধীজনের ব্যাপক প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়। কর্ম জীবনে তিনি রাজস্থলী উপজেলা স্কাউটসের সম্পাদক হিসেবে অনেক কাব হলিডে ও একটি কাব ক্যাম্পুরী আয়োজনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি গাজীপুরের মৌচাকে ষষ্ঠ বাংলাদেশ জাতীয় স্কাউটস জাম্বুরীতে একটি সাব ক্যাম্পের এসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর এডমিনিস্ট্রেশণ এর দায়িত্ব পালন করেন।
মেট্রিকুলেশন পাশের ২৪ বছর পর ১৯৯৬ সালে তিনি রাঙ্গামাটি মহাবিদ্যালয় হতে আই.এ পাশ করেন। পরবর্তীতে এই সনদ তাঁকে ১৯৯৮ সালে প্রধান শিক্ষক পদে প্রমোশন পেতে সাহায্য করে। চাকুরীর মেয়াদ শেষ হবার দুই বছর আগে ২০১৪ সালে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে চাকুরী হতে অবসর গ্রহণ করেন।
তঞ্চঙ্গ্যা জাতির কল্যাণে এই মহান পুরুষের অবদান কম নয়। ১৯৯৬-৯৭ সালে জাতি হিসেবে ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ নামে বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভের জন্য বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা (বাতকস) তোড়জোড় শুরু করে। বাতকসের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির একটি দল ২৩/০১/১৯৯৭ তারিখে ঢাকায় জাতীয় সংসদের চীফ হুইফ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর অফিসে উপস্থিত হয়ে স্মারক লিপি প্রদান করে। বাতকসের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনিও সেই দলের একজন হিসেবে আজও গর্ব করেন।
২০০৮ সালে গঠিত ‘তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা আহ্বায়ক কমিটি’র একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে কমিটির ১১তম বৈঠকে তাঁকে উক্ত কমিটির সহ-সদস্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। (এ সম্বন্ধে আরও পড়–ন তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটি।)
তিনি একজন গীতিকার, কবি, নাট্যকার, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। বিগত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি লেখালেখির সাথে জড়িত। তিনি কবিতা ও গান লিখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর রচিত অনেক কিস্সা, গান, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটিকা প্রভৃতি প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর রচিত অনেক গান খুবই জনপ্রিয়। সেগুলোর মধ্যে আছে ‘ঝিঙাফুল ও ঝিঙাফুল’, ‘ও বুয়ারান’, ‘ও পরান দা ন লাচাইত’ প্রভৃতি। ২০১৫ সালে তাঁর রচিত তঞ্চঙ্গ্যা-বাংলা গানের মিশ্র সংকলন “ঝিঙা ফুল” প্রকাশিত হয়। এটি ছিল তাঁর রচিত প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ।
তিনি বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউটে (১) তঞ্চঙ্গ্যা কিস্সা সংকলন (১ম খ-), (২) তঞ্চঙ্গ্যা সামাজিক প্রথা, বিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার এবং আচার আচরণ ও (৩) তঞ্চঙ্গ্যা দাঅ কধা আ মর দি-এক্কয়া শোলোক নামে তিনটি পা-ুলিপি জমা দিয়েছেন। এছাড়া তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ চড়ঙ্-চাড়াঙ্, ফুকালাঙ্; বাংলা ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ সিঙ্গুবী, (জাতক থেকে নাটক) বোধিকুমার, উন্মাদয়ন্তী, মনিচোর, দেবধর্ম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তঞ্চঙ্গ্যা-বাংলা-ইংরেজী ত্রিভাষিক শব্দকোষ “ইম্পোর্টেন্ট ওয়ার্ড বুক” নামক পা-ুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। তাঁর রচিত গুঁই চান সল্লা নামক একটি রূপক নাটিকা পহ্র জাঙাল সাময়িকীর ৪র্থ সংখ্যায়।
শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির এই গুণীজন বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যা কিস্সা সংকলন এর দ্বিতীয় খ-ের পা-ুলিপি প্রস্তুতের কাজ করছেন। কামনা করি, তঞ্চঙ্গ্যা জাতির কল্যাণে এই গুণীজন দীর্ঘকাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন।
১৯৩২ থেকে ২০১৬, এই দীর্ঘ ৮৫ বছরের ইতিহাসে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মাত্র এই নয় জনের স্বরচিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সংখ্যার বিবেচনায় তঞ্চঙ্গ্যা গ্রন্থকারের সংখ্যা খুবই নগণ্য। রচিত গ্রন্থের সংখ্যাও সীমিত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার লৈখিক ভিত্তি দৃঢ় করতে হলে লেখকের সংখ্যা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত পুস্তকের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এজন্য নতুন নতুন লেখক সৃষ্টিতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। লেখকদের অপ্রকাশিত পা-ুলিপি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যে সমস্ত লেখকের পুস্তক অনেক আগে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। সুতরাং সেগুলোও পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এসমস্ত পুস্তক প্রকাশের জন্য বাতকসের একটি প্রকাশনা কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। লেখনীর শুভ সূচনা যখন হয়েছে, আশা করা যায়, এই ধারা ভবিষ্যতে আরও দ্রুত সম্প্রসারিত হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS